ডার্ক_সাইড, 

লেখা_নাহিদ হাসান নিবিড়

#শেষপর্ব


...

ঈশিকার সাথে রাতে আর কথা হয়নি, আমি ফোন করিনি, ঈশিকাও ফোন করেনি। রাতটা কেমন ছটফট করতে করতে কেটে গেল। সকালবেলা বাবা বললেন, আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

.

চট্টগ্রামে আমার এক দুসম্পর্কের খালার বাড়ি। তার বড় ছেলের বিয়ে। বাবা যেতে পারছেন না, মা'র সাথে তাই আমাকে যেতে হবে।

.

বিকেলবেলা ঈশিকাকে ফোন করে চট্টগ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার কথা জানালাম। মাত্র দু'তিনদিনের ব্যাপার অথচ মনটা বেজায় খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই শহর ছেড়ে চিরতরেই বুঝি চলে যাচ্ছি। ঈশিকার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না।

.

রাতের গাড়িতে মাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।

.

পরের দিন ঈশিকার দুপুরবেলা ঈশিকা ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো, পৌঁছেছো?

 আমি বললাম, হ্যাঁ ফজর ওয়াক্তে এসেছি।

 ঈশিকা মন খারাপ করে বলল, জানালে না তো।

  --ভাবলাম ঘুমিয়ে আছো, সেজন্য ফোন করিনি।

  --ম্যাসেজ তো দিতে পারতে, সে যাই হোক ফিরবে কবে?

  --কাল পরশু।

  --তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, ভালো লাগছে না আমার।

  --কি হয়েছে?

  --জানি না, কেমন যেন লাগছে।

.

বিকেলবেলা, রাতে ঈশিকা বেশ কয়েকবার ফোন করে ভালো না লাগার কথা বলল, দ্রুত ঢাকায় ফেরার কথা জানিয়ে বলল, আমাকে তার দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। 

.

ঈশিকার জন্য মনটা আমারও কাঁদছে, কেমন একটা মায়া যেন জন্মে গিয়েছে, দুটো দিনের তর সইছে না।

.

.

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে শহরে ফিরে আসলাম। শহরে ফিরে এসে প্রথমেই ঈশিকার সাথে দেখা করেছি। সারাটাদিন ঈশিকার সাথে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে লম্বা একটা ঘুম দিয়েছি, গভীর রাতে হঠাৎই ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঈশিকার ফোন, ফোন ধরতেই ঈশিকা বলল, "কাল বিকেলে একটু দেখা করবে?"

আমি সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলাম।

.

দুপুরবেলা ঈশিকা ফোন করে বলল, তোমার একটা মেরুন রঙের টি-শার্ট আছে না? ওটা পরে এসো।

আমি টি-শার্ট পরে রওনা করলাম।

.

নিউ ইস্কাটন রোডের একটা ক্যাফেটেরিয়াতে ঈশিকার সাথে দেখা করার কথা। ক্যাফেটেরিয়াতে পৌঁছে দেখি, ঈশিকাও মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। ক্যাফেটেরিয়াতে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম বসুন্ধরা সিটিতে। সিনেপ্লেক্সে নতুন একটা মুভি চলছে। ঈশিকা বলল, মুভি দেখবে। আমারও বেশ ইচ্ছা করছিল।

.

মুভি দেখে বাড়ি ফিরে লম্বা সময় ঈশিকার সাথে ফোনে কথা হলো। মা বেশ কয়বার রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডেকেছে। খাওয়ার চেয়ে কথা বলাটা আমার কাছে মুখ্য বিষয় মনে হচ্ছিল। মা ঘরের দরজা ধাক্কাছিল কেন যেন হঠাৎ মেজাজটা চড়ে গেল, আমি অনেকটা চেঁচিয়ে বললাম, খাবো না, যাও তো। 

.

.

আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক দিনকে দিন গভীর হতে হতে এক পর্যায়ে এতোটাই গভীর হয়েছিল যে তার মুখ দেখলে আমি বলে দিতে পারতাম সে ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। ঈশিকাও এই দিক থেকে পিছিয়ে ছিলো না। একজন আরেকজনকে বুঝবার গভীর একটা প্রয়াস আমাদের মাঝে ছিল। দিনান্তে ঈশিকার প্রণয়ের ঝড় আমার উপরে এসে থেমেছে। আমি সাড়া দিতে চাইনি, কোনভাবেই না। জীবনে একবার বড় ধরনের কষ্ট পেলে মানুষের বেশ শিক্ষা হয়। অতি সূক্ষ্ম একটা শিক্ষা আমার ছোটবেলার বন্ধু রিতু আমাকে দিয়ে গেছে। আমি নতুনরুপে আর কোন প্রণয় ঘটিত শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে চাই না।

.

নারী আসক্তি থেকে কোন পুরুষই বা মুক্ত? মেডিকেল সাইন্স বলে, যেই পুরুষের নারীর প্রতি আগ্রহ নেই তার শারীরিক সমস্যা রয়েছে। আমার কোন শারীরিক সমস্যা নেই। ঈশিকার সাথে নিয়মিত দেখা হয়, সে আমার গা ঘেঁষে বসে, আবেদন ছড়ায়, ভালোবাসার কথা বলে। নিয়মিত যত্ন নেয়, দূরে কোথাও গেলে দ্রুত ফিরবার তাড়া দেয়, না ফিরলে জেদ চেপে বসে।

.

এমনিভাবে ঈশিকা কখন, কবে, কিভাবে আমার মন দখল করে নিলো আমি হলফ করে বলতে পারি না। ঈশিকা যেন আমারই অস্তিত্বের একটা অংশ হয়ে গেছে, তাকে ছাড়া ভাল লাগে না।

.

আমরা একসাথে রিকশায় ঘুরে বেড়াই, বৃষ্টিতে ভিজি, হাঁটি পথে পথে—মাঝে মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়। দু একদিন যোগাযোগের ইস্তফা ঘটলে তার কান্নামিশ্রিত কন্ঠ, আমার প্রেমাসিক্ত হৃদয়, ফের দেখা হয়, ফের গোটা রাত্রি মুঠোফনে কথা হয়, ফের একদিন ঝগড়া হয়।

.

এভাবে দিন কাটতে কাটতে আমাদের সম্পর্ক যখন পুরোদমে এগিয়ে চলেছে এক পড়ন্ত বিকেলবেলা ঈশিকা আমাকে ফোন করে বলল, তার বিয়ে ঠিক। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “ইয়ারকি করো না তো।”

ঈশিকা কান্নামিশ্রিতকণ্ঠে বলল,

  --অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম কথাটা তোমাকে বলবো, কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম,

  --তাহলে এতোদিন যা করলে এসব কি ছিল?”

  --জানি না। তবে এমনটা মনে করো না, আমি তোমায় ভালোবাসি না। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা অন্যরকম। এতোদিন যেমন ছিলে সবসময় এমনিভাবে পাশে থেকো।

.

তখনও গোটা বিষয়টাই আমার কাছে ইয়ারকি বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু সপ্তাহখানেক পর আনুষ্ঠানিকভাবে যখন ঈশিকা তার হবু বরের সাথে সামনা-সামনি আমার পরিচয় করিয়ে দিল, তখন আর বিশ্বাস না করে উপায় কী?

.

রিক্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরে এসে ঠিক করলাম, জীবনে আর কখনো ঈশিকার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবো না, শুধু ঈশিকা নয় এই পৃথিবীর কোন নারীর সাথেই কখনো যোগাযোগ করবো না।

.

রিতুর পর ঈশিকা আমার দ্বিতীয় ডার্ক সাইডে পরিণত  হলো। রাতগুলো বেমালুম স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। একদিকে রিতু অন্যদিকে ঈশিকা, দুজনের মধ্যকার স্মৃতিগুলো একটুকুও ধুসর হয়ে যায় না, চোখের সামনে রুপোলী পর্দায় সর্বক্ষণ ভেসে বেড়ায়। জীবনটা তীব্র বিষাদময় হয়ে গিয়েছে, কিছুই আর ভালো লাগে না। মা প্রায়শই জিজ্ঞাসা করে, “তোর কি হয়েছেরে? এমন মনমরা হয়ে থাকিস কেন?” আমি প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারি না।

.

ঈশিকা মাঝে মাঝে ফোন করে, আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না, ফোন ধরি না। সে লাগাতার ফোন করতে থাকে, কান্নামিশ্রিত গলায় অডিও রেকর্ড করে পাঠায়, ভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে।

.

ঈশিকার ফোন ধরলেই সে কান্নাকাটি করে তার পাশে থাকবার কথা বলে, আমি ফোন রেখে দিয়ে হাসি। আমার বুঝি হৃদয় নেই, আমি বুঝি মানুষ নই, আমার বুঝি জীবন নেই।

.

.

মাস দুয়েক কেটে গেছে, ঈশিকার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ নেই। সে যোগাযোগ করবার চেষ্টা মাঝে মধ্যে করে। আমি এমন কেন করছি সেই কথা লিখে পাঠায়, আমি প্রতিত্তোরে কিছু বলি না। প্রশ্ন আমারও অসংখ্য, সেসব গাছেদের জন্য, রাতের আকাশের জন্য। ওরা চুপচাপ আমার কথা শোনে, সবসময় পাশে থাকে, কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেয় না, কখনো সঙ্গ কামনা করে না, অথচ আমি চাইলেই সঙ্গ দেয়।

.

ছাদে বেশকিছু নতুন গাছ লাগিয়েছি, ঘরে বনসাই করার চেষ্টায় মত্ত হয়েছি। মা আর আমি মিলে প্রতিদিন ছাদে গিয়ে গাছের পরিচর্যা করি।

.

মাঝে মাঝে রাতে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। বৃষ্টি এলে ভিজি। অতীতের স্মৃতি থেকে মুক্তি আমার কোনকিছুতেই মিলছে না, হয়তো কখনো মিলবে না। স্মৃতি মুছে ফেলবার কোন পন্থা আজও আবিস্কার হয়নি। হয়তো কোন একদিন হবে, বিষাদময় স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা যাবে। তখন অসংখ্য মানুষ এসব বিষাদময় দিন-রাত্রি থেকে মুক্তি পাবে। জীবনে অসংখ্য মানুষ আসবে কারও প্রস্থান কষ্টের হলেই ঘ্যাচাং করে তার সাথেকার সব স্মৃতি মুছে ফেলা যাবে। এখনও যেহেতু এমন কোন উপায় বের হয়নি সেহেতু আমাকে এইসব দিন-রাতগুলো নিয়েই থাকতে হবে। মন বড্ড খারাপ করলে ছাদে যাব, আকাশের তারাদের সাথে, চাঁদের সাথে, গাছেদের সাথে গল্প করবো। ঘুরে বেড়াবো পৃথিবীর এপার থেকে ওপারে তবুও নতুন করে কারও সঙ্গ আমি কামনা করবো না। অথবা কোন একদিন আবারো কেউ আমার তৃতীয় ডার্ক সাইডে পরিণত হবে। আজ রাতের মতো সেদিনও আমার হৃদয় থেকে লক্ষ-কোটি তারাদের দিকে তাকিয়ে উত্থিত হবে,


আমার দিবস রাত্রি কাটে, ব্যথাতুর অশান্ত এক হৃদয় নিয়ে

তার আবির্ভাব আমার মোহগ্রস্থ হৃদয়ে জন্ম দিয়েছে একটা আকাশ,

আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করে মিটিমিটি তারা,

গোটা মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল অলীক স্মৃতিদের ছুটোছুটি,

আমি অপেক্ষা করে রই...

দীর্ঘ রজনীর আকাশভরা তারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি,

বহুদিনের জমে থাকা চুপকথারা হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসে,

"আমার আকাশভরা তারার মাঝে তোমরা দুটি দুঃখতারা।"

...

সমাপ্ত।