ডার্ক_সাইড,
#পর্ব_০১
©নাহিদ হাসান নিবিড়
.....
এক মধ্যদুপুরে ঈশিকা আমার সাথে দেখা করে বলেছিল, “আমার জীবনে কিছু ডার্ক সাইড আছে।”
.
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কেমন?”
ঈশিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে তাকিয়ে জানিয়েছিল,
সে একে একে তিনজনের সাথে প্রেমের জড়িয়ে পড়েছিল। দুজন তাকে কষ্ট দিয়েছে, একজনের চালচলন, হাবভাব ঈশিকার ভালো লাগত না সেজন্য সম্পর্কও খুব বেশিদূর এগোয়নি। পুরানো স্মৃতি তাকে কষ্ট দেয়।
.
বর্তমানে এক চর্মরোগের ডাক্তারের সাথে ঈশিকার কথাবার্তা চলছে, সে নাকি আকারে ইঙ্গিতে তাকে প্রেমের বিষয়টি বুঝাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। এইদিকে তার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর হাবে-ভাবে মনে হচ্ছে সে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসবে—প্রস্তাব দিলে তার ইচ্ছা সেই ছেলেটির সাথে সংসার জীবনে ঝুলে পড়া অন্যদিকে অর্থনীতি বিভাগের ফার্স্টক্লাস প্রাপ্ত হৃদয়ের জন্যেও তার মন কাঁদে। ছেলেটা অনাথ, মা-বাবা নেই।
.
হৃদয় চাকরি খুঁজছে। ঈশিকার মুখে তার অহরহ প্রশংসা শুনে মনে হয়েছিল এই ছেলেকেই সে জীবনসঙ্গী করবে, কিঞ্চিৎ হয়েছিলোও তাই। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই হৃদয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়ে গেল। ঈশিকার স্কুল বন্ধুটার কি খবর, ডাক্তার সাহেবের অবস্থাই বা কী, কে জানে! নারীদের পেছনে পুরুষদের একটা লম্বা সিরিয়াল সর্বদাই লেগে থাকে তবুও শোনা যায় সংসারে মেয়ে জন্মালে বাবারা অখুশ হন, কেন অখুশ হন আমার বোধগম্য হয় না।
.
ঈশিকা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। আমরা একসাথে একই বিভাগে পড়াশোনা করেছি। ঈশিকাকে আমাদের বাংলা বিভাগের সবথেকে শান্তশিষ্ট, ভদ্র মেয়ে হিসেবে জানতাম। মাঝে মাঝে তার সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতো, ফোনে কথা হতো। ঈশিকার এহেন অবস্থা শুনলে হয়ত অনেকেই অবাক হবে, নানারকম মন্তব্য করবে কিন্তু আমার ধারণা ভিন্ন।
.
মানুষের জীবনে ভালো দিক যেমন থাকবে খারাপ দিকও তেমনি থাকবে এমনটাই আমি বিশ্বাস করি। মানুষের মাঝে কেবল নিজের ভালো দিকগুলো দেখানোর একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়—মূলত মানুষ চায় মানুষের সন্মান-শ্রদ্ধার পাত্র হতে, সুনাম কামাতে। যেই লোক নিজে খাদ্যে ভেজাল মেশায় সে নিজেও ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত মিছিলের প্রথম কাতারে অবস্থান করে। যিনি ঘুষ খেয়ে খেয়ে ভুড়ি ফুলিয়ে মস্ত বানিয়েছেন তিনিও ঘুষের বিপক্ষে। নারী আসক্ত পুরুষ মানুষ নারীর বিরুদ্ধে নানারকম আজে-বাজে কথা বলে বেড়ালেও দিন শেষে নিজের বউ রেখে অন্য নারীর দেহ উপভোগের ফন্দী আঁটে। স্বামী বিদেশে থাকার সুযোগে যেই নারীটি দিব্যি প্রেম করে বেড়াচ্ছে সে তার পাশের বাড়ির মহিলাটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মূলত তলে তলে কম-বেশি সবার অবস্থা শীতকালের বুড়িগঙ্গার জলের মতো কিন্তু বাস্তবে সবাই সাধু।
ঈশিকার অতি সহজ-সরল স্বীকারোক্তি আমার বেশ ভালো লেগেছিল, ডার্ক সাইড প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কম বেশি রয়েছে, আমার জীবনেও রয়েছে।
.
একজনকে খুব মনে ধরেছিল—সে আমার ছোটবেলার বন্ধু রিতু। সম্পর্কের জন্য যত প্রকার চেষ্টার প্রয়োজন আমি করেছি, রাতের পর রাত জেগে পত্র লিখে পাঠিয়েছি, তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে একটু দেখবার জন্য ছটফট করেছি, বিশেষ দিনগুলোতে নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে উপহার পাঠিয়েছি, তার মাস্টার্সের ক্লাস চলাকালীন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত, আমি তার অপেক্ষায় টানা একটা বছর তাদের মহল্লার গাড়ির স্ট্যাণ্ডে যাত্রী ছাউনিতে বসে কোটি কোটি মশার কামড় সহ্য করেছি। সর্বস্ব উজার করে দিয়ে তার কাছ থেকে সিমপ্যাথি ব্যতীত আর কিছু আমি পাইনি। আমার প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিয়েছিল, অথচ কোন কারণ সে উল্লেখ করতে পারেনি, শুধু বলে গেছে, “সে আমার ভালোবাসার যোগ্য নয়, তার থেকে অনেক গুণ ভালো কোন মেয়ে আমার জীবনে আসবে।”
.
রিতুকে মনে পড়ে খুব, অথচ সে আমার নয়, বড়লোক স্বামীর ঘর করছে, দিব্যি হাসিমুখে স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে ছবি তুলছে। আমার অপারগতা বুঝি কেবল অর্থের ছিল, খুব কষ্ট হয়—অসীম কষ্ট বুকে চেপে জীবন ধারন করছি। নতুন কোন ডার্ক সাইড আমি চাই না। জীবনের সকল চাহিদাকে সীমিত করে ফেলেছি। গাড়ি-বাড়ি, অঢেল টাকা-পয়সা, প্রেম, বিয়ে কোনকিছুর অতি চাহিদা আমার নেই—হলে হবে নাহলে নেই। জীবনটা যেভাবে একদিন শুরু হয়েছিল, সেভাবেই একদিন ফুরিয়ে যাবে, অনর্থক এসবের পিছনে ছুটে ছুটে জীবনের ষোল আনা বিনষ্ট করে জীবনকে বিপন্ন করার কি মানে? পৃথিবী ভ্রমণে এসেছি পৃথিবী দেখে যাওয়াটাই আমার কাছে মূখ্য বিষয় বলে মনে হয় বাকি সব মিছে—সেজন্য ঘুরে বেড়াই, ছাদে কিছু গাছ লাগিয়েছি, তাদেরকে খুব খুব ভালোবাসি, তারা কখনো প্রতারণা করে না। উল্টো ভালোবাসার ফসল আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রাণ ত্যাগ করে, ওদের জন্য আমার খারাপ লাগে, টমেটো গাছ-বেগুন গাছ গুলো ফল দিয়েই আমাকে ছেড়ে দলে দলে বিদায় নেয়। আহা ওরা যদি কথা বলতে পারতো, যদি হাঁটতে পারতো, তাহলে আমার মতো বহু মানুষ হয়তো প্রেম ঘটিত দুঃখ-কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেত! মানুষের তো আর স্মৃতি মুছে ফেলবার কোন উপায় নেই, স্মৃতিরা সর্বদা ঘুরে ফিরে এসে দিন-রাতের হিসাব নিকাশ সব বদলে দেয়। সর্বদা মানুষের একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন, একটু কথা বলবার জন্য, একটু সঙ্গ দেবার জন্য।
.
বিয়ে-শাদি, টাকা-পয়সা নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা না থাকলেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজনবোধ আমাকে বেশ পীড়া দিতো। ঈশিকা আমাকে সেই পীড়াদায়ক প্রহর থেকে মুক্তি দিয়েছিল। হঠাৎই একদিন ঈশিকা ফোন করে কান্নামিশ্রিতকণ্ঠে জানালো,
“হৃদয়ের সাথে তার সম্পর্ক চুকে গেছে। ঈশিকার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় সে নাকি আরেক মেয়ের সাথেও সম্পর্ক কন্টিনিউ করছিল।”
.
একাধিক প্রেম, বিচ্ছেদ এই যুগের এক প্রকার ট্রেন্ড হয়ে গেছে। বন্ধুদের বেশ কয়জনকে দেখেছি, বিয়ের আগে প্রেমিকার জন্য উন্মাদ রইলেও বিয়ের পর থেকে তাদেরকে ভালো না লাগার এক স্থায়ী রোগে পেয়ে বসেছে। দু'একজনের বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে গেছে, কিন্তু প্রেম থেমে নেই।
.
হৃদয়ের সাথে বিচ্ছেদের পর ঈশিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কোন প্রেমের সম্পর্কে সে জড়াবে না। ইদানীং প্রতিদিন ফোন করে সে আমার খোঁজ-খবর নেয়। প্রায়শই আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কোনদিন রবীন্দ্র সরোবর, কোনদিন টি.এস.সি, কোন কোনদিন আমরা ব্লকবাস্টারে সিনেমা দেখতে যাই, সময় মন্দ যাচ্ছে না।
.
জীবনে একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন ছিল, ঈশিকা সেই অভাব পূরণ করেছে। গাছেদের মতো তাকেও আমি বন্ধু ভাবতে শুরু করেছি। রিতুর প্রত্যাখানের দহন সয়েছি দীর্ঘদিন, আমার প্রতিদিনকার জীবনে ঈশিকার প্রভাব সেই দহনের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
.
আমাদের দুজনের বন্ধুকূলের মাঝে আমাদের আলাদা একটা স্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বন্ধুরা আজকাল আমার খোঁজ-খবর নেয় ঈশিকার কাছ থেকে, ঈশিকার খোঁজ-খবর নেয় আমার কাছ থেকে। কিছু বন্ধু-বান্ধব দুষ্টামির ছলে আমাদের দুজনের মধ্যে বিদ্যমান গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। কেউ কেউ বিয়ের খোঁজ-খবর নেয়, ব্যাপারগুলো মন্দ লাগে না।
.
.
মাঝে মাঝে ঈশিকার মন খারাপের রোগ হয়, অতীত দিনের স্মৃতিরা মেঘবর্ষণের মতো তার মনের আকাশ ছেয়ে ফেলে, মেয়েটা মনমরা হয়ে থাকে—আমার ভালো লাগে না, খুব ইচ্ছা করে তার মনের মাঝে প্রবেশ করে অতীত জীবনের সকল বিষাদের স্মৃতি মুছে দেই কিন্তু মানুষের কি এমন সাধ্যি, আরেকজনের মনের চিকিৎসা করে? নিজেরও তো একটা মন আছে, তার চিকিৎসাই তো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হয় না অন্য মানুষেরটা করবে কী?
.
ঈশিকার মন খারাপের দিনে সব কাজ কর্ম ফেলে আমার একমাত্র কাজ হয় ঈশিকাকে সঙ্গ দেওয়া। দীর্ঘদিনের বিষাদের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে, বিষাদ মানেই কিছু ভালো না লাগা, নিজেকে যতপ্রকার কষ্টের জোয়ারে ভাসানো যায় ভাসিয়ে দেওয়া। আমি চাইনা ঈশিকা কষ্টে থাকুক, মনমরা হয়ে থাকুক। আমি বার বার ঈশিকাকে ফোন করি। সে ফোন ধরে, আবার ধরে না—কথা বলতে ইচ্ছা করছে না জানায়, আবার নিজেই ফোন করে স্যরি বলে। এভাবেই নিত্যদিনের সঙ্গী ঈশিকার সাথে আমার দিনাপাত চলছে।
.
ঈশিকার সাথে প্রতি শুক্রবার আমার বাইরে বের হওয়াটা এক প্রকার নিয়ম হয়ে গেছে, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ গভীর সন্ধ্যা পর্যন্ত টি.এস.সিতে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য সি.এন.জি খুঁজছিলাম,
ঈশিকা বলল, “আমার রিকশায় যেতে ইচ্ছা করছে।”
আমি একটা রিকশা ঠিক করে ঈশিকাকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম।
বেশকিছুক্ষণের নিরবতার পর ঈশিকা বলল, “তোমার হাত টা দেবে?”
আমি সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিলাম। ঈশিকা আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
--থ্যাংস।
--কেন হঠাৎ থ্যাংস কেন?
--তোমার মতো এমন করে কেউ আমাকে বুঝবার চেষ্টা করেনি। এমনিভাবে ছায়ার মতো সঙ্গ দেয়নি। একটা রিকোয়েস্ট করবো?
--হ্যাঁ করো।
--কখনো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, প্লীজ।
ঈশিকার চোখদুটো ছলছল করছিল, এই বুঝি চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি দুষ্টামির ছলে বললাম,
--হ্যাঁ ছেড়ে যাব তো, এই যে এই মুহুর্তেই ছেড়ে যাব। রিকশা থামান তো।
রিকশাচালক সত্যি সত্যি রাস্তার পাশে রিকশা থামালো। ঈশিকা কপালভাঁজ করে আমার দিকে তাকালো। আমি রিকশাচালককে বললাম, “আপনি দেখি সত্যি সত্যি থামিয়ে ফেলেছেন। আমি মিথ্যা মিথ্যা থামাতে বলেছিলাম।”
রিকশাচালক ফিক করে হেসে ফেলে বলল, “বুঝতে পারি নাই বাবা।”
.
রিকশা চলতে শুরু করেছে। ঈশিকা ফের আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপটি করে আছে। খানিক সময় পর আমার হাতে কয়েকফোটা জলের অস্তিত্ব টের পেলাম, ঈশিকা কাঁদছে, তার চোখ থেকে গাল বেয়ে টপটপ করে চোখের জল আমার হাতে পড়ছে। আমি ঈশিকা ঈশিকার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, “এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?”
ঈশিকার কান্নার গতিবেগ আরও বেড়ে গেল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কিছু কিছু মুহুর্তের বর্ণনা করা সম্ভব নয়—এই মুহুর্তটাও ঠিক তেমন। এই মনে হচ্ছে ঈশিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি, আবার মনে হচ্ছে কাঁদতে বারণ করি, চোখের জল মুছে দেই, ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে ঈশিকাকে নিয়ে সাগরতীরে চলে যাই, পাহাড়ে-পর্বতে, দূরের কোন গ্রহ-নক্ষত্রে চলে যাই। এ কেমন মায়া, কেমন আকাংখা আমি জানি না, মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে ভীষণ।
.
পুরোটা রাস্তা আমি একটা কথাও আর বলতে পারলাম না, ঈশিকাও পুরো রাস্তা নিরব থেকেছে। রিকশা থেকে নেমে ঈশিকা মৃদু গলায় শুধু বলল, “যাচ্ছি।”
আমি জানি না আমার এই খানিক সময়ের মধ্যে কি হয়ে গেল, ঈশিকাকে আমার যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না।
.....
#চলবে
0 Comments
💬✨ মন্তব্য করার নিয়মাবলী ✨💬
🙏😊 দয়া করে ভদ্র ভাষায় মন্তব্য করুন।
🚫❌ অপ্রাসঙ্গিক বা স্প্যাম মন্তব্য প্রকাশ করা হবে না।
💡💖 আপনার মতামত আমাদের জন্য খুবই মূল্যবান।
📚✍️ গল্প নিয়ে আপনার চিন্তা, অনুভূতি বা প্রস্তাব লিখে জানাতে পারেন।
🌟🌍 চলুন আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করি।
ধন্যবাদ! 💝🌸🎉