#বহুরূপী

#শেষপর্ব


লেখা- নাহিদ হাসান নিবিড়


...

অফিস থেকে বের হয়ে সুমনের নম্বরে ফোন করলাম। ফোন ধরল তাঁর স্ত্রী পিয়া। পিয়া জানাল, সুমন বি.আর.বি হাসপাতালে ১০২৪ নম্বর কেবিনে ভর্তি আছে। সে অসুস্থ। আমি উবার নিয়ে সোজা বি.আর.বি হাসপাতালে চলে গেলাম।

  সুমন বেডে শুয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ অসুস্থ। অহনা যেই সুমনের ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক দিয়েছে তাঁর সাথে এই সুমনের কোন মিল নেই। ফেসবুকে যেই সুমনকে দেখেছি সে দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা, স্বাস্হ্য বেশ ভাল। তাকে আমার প্রাণবন্ত একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে। এখন যাকে দেখছি, তাকে দেখতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ হা করে সে শ্বাস নিচ্ছে। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

  পিয়া বলল, মাসখানেক আগে সুমনের ব্ল্যাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ক্যামো নিতে তাঁরা ঢাকায় এসেছিল, কিন্তু ক্যামো নেবার আগেই ডাক্তাররা জানিয়েছে সুমনের লিভার পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে, তাদের করার মতো কিছু নাই।


হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পান্থকুঞ্জ পার্কে গিয়ে বসলাম। সুমনকে দেখার পর থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। কয়দিনের মধ্যে কি অবস্থা হয়েছে মানুষটার! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অহনাকে ফোন করলাম।

অহনা ফোন ধরে বলল,

"সুমনের সাথে কথা হলো?"

আমি বললাম,

"সুমন কথা বলার মতন অবস্থায় নেই। আপনি বি.আর.বি হাসপাতালের ১০২৪নম্বর কেবিনে গিয়ে সুমনকে একবার দেখে আসুন। সে সম্ভবত আর বাঁচবে না।"

--"হোয়াট!"

  আমি ফোন রেখে দিলাম।


দিপা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। লিখেছে,

"কি অবস্থা ভাইয়া?"

আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই না দিয়ে দিপাকে ফোন দিলাম। দিপা ফোন ধরে জিজ্ঞাসা করল,

"কেমন আছেন ভাইয়া।"

--"এইতো আপু ভাল। আপনি ভাল আছেন?"

--"খুব ভাল। কি করছেন ভাইয়া? দুপুরে খেয়েছেন?"

--"বসে আছি, খাওয়া-দাওয়া এখনো হয়নি।"

--"ওমা! দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে, এখনো খাননি কেন?"

--"মনটা ভাল না। খেতে ইচ্ছা করছে না।"

--"কি হয়েছে ভাইয়া? অহনার ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ?"

  আমি কিছু বললাম না।

দিপা বলল,

"গতকাল অহনার সাথে সামনা-সামনি কথা বললেন, কিছু ঠিক হয়নি?"

আমি বললাম,

"নাহ।"

--"ভাইয়া যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলব?"

--"বলুন আপু।"

--"কথাটা আসলে বলা ঠিক হবে কি না জানি না তারপরও বলছি। দেখুন ভাইয়া, অহনা আমার সবথেকে ভাল বন্ধু, কিন্তু ওর এই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না। এসব না বোঝার কি আছে? আমি কত করে বললাম, দেখ ছবিগুলো তো ফেইক হতে পারে। আর আপনিও পড়ে আছেন অহনার পিছে, পৃথিবীতে কি মেয়ে মানুষের অভাব? যে আপনাকে এই সামান্য ব্যাপারে সন্দেহ করছে তাকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করবেন কি করে?"

আমি বললাম,

"আপু, বিয়ের সব এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী সবাইকে দাওয়াত করা হয়ে গেছে, এমন সময় বিয়েটা না হলে কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন?"

--"তা তো ঠিক।"

--"আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, বিয়ের চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমার চরিত্র নিয়ে যেই প্রশ্নটা উঠেছে আমি তা থেকে মুক্তি পেতে চাই।"

--"এখন কি করবেন?"

--"যে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করব।"

--"ব্যাপারটা তো সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। যে এসব করছে সে তো নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। সে নিজেকে প্রকাশ না করলে কিভাবে খুঁজে বের করবেন? মনে করুন, আমি করেছি আমি কি আপনাকে বলব, যে আমি করছি?"

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

"আপনি এমন করলে অহনাই আপনাকে ধরে ফেলত।"

--"তা ঠিক বলেছেন।"

--"আচ্ছা আপু তাহলে রাখি।"

  আমি ফোন রেখে দেবার পর, দিপা ম্যাসেজে লিখল, ভাইয়া খেয়ে নিয়েন, নইলে শরীর খারাপ করবে।


পার্ক থেকে উঠে শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে এসে একটা রিক্সা নিলাম। খানিক সময় পর রাকিবের ফোন এলো। আমি ফোন ধরলাম।

রাকিব তাড়াহুড়ো করে বলল,

"ভাইয়া আপনার সাথে আমার খুব দেখা করা প্রয়োজন।"

--"কেন রাকিব? কিছু বলবে?"

--"হ্যাঁ।"

--"ফোনে বল।"

--"ভাইয়া, ডিউটিতে তো ফোনে কথা বলা নিষেধ, একটু পর পর স্যাররা ডাকেন। তাছাড়া কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে হবে।"

--"আচ্ছা আমি বসকে ফোন করে ব্যবস্থা করছি, তুমি আমার বাসায় চলে এসো। আমার বাসা চেনো তো?"

--"ভাইয়া বাসা তো চিনি না।"

--"আচ্ছা ধুপখোলা মাঠে এসে আমাকে একটা ফোন দিয়ো, আমি বলে দেবো।"

  রাকিবের সাথে কথা বলা শেষ করে বসকে ফোন দিয়ে রাকিবের ছুটির ব্যাপারে বললাম। বস বললেন, অফিসে কয়েকজন গেস্ট আসবে, রাকিবকে গিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে। গেস্ট নিয়ে আসার পর রাকিবকে ছাড়তে পারবেন।

  এখন বাজে সোয়া তিনটা। সন্ধ্যার আগে রাকিবের সাথে দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে না।


বাড়ি ফিরে, গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর বাবা বললেন,

"আগামীকাল অহনাদের বাড়িতে কাকে কাকে পাঠানো যায় রে?"

আমি বললাম,

"কেন বাবা?"

বাবা কপাল কুঁচকে বললেন,

"শাড়ী-গয়নাগাটি পাঠাতে হবে না?"

--"ও হ্যাঁ। কখন পাঠাবে?"

--"বিকেলের দিকে গেলে ভাল হয় না?"

--"হু, বিকেলের দিকে রোদটা কম থাকে।"

--"তোর মা যাক, সাথে আর কে কে যাবে?"

--"রিফাত, সিফাতকে পাঠিয়ে দাও। কাকা গেলে ভাল হয়। আর তুমি যাবে না?"

--"আমি যাব নারে।"

--"তাহলে ছোটখালা আর কাকাকে ফোন করে বলে দাও চলে আসতে। খালাকে বলো, সেতুদেরকেও যেন নিয়ে আসে।"

--"কালকে তুই ফ্রি আছিস?"

--"কেন বাবা?"

--"ফ্রি থাকলে, তোকে নিয়ে বের হোতাম। বার বার গাড়ি ভাড়া করতে আর ভাল লাগে না। নিজেদের একটা গাড়ির দরকার। একটা প্রাইভেট কার কিনে ফেলি কি বলিস?"

  গাড়ি কেনার কথা শুনে খুশি হবার কথা ছিল, খুশি হতে পারলাম না, গাড়ি কিনতে গেলে অনেকগুলো সময় নষ্ট হবে। আমার হাতে সময় কম।

হাসি হাসি মুখে বললাম,

"এতোদিনে বুঝলে আমাদের একটা গাড়ি দরকার?"

বাবা বললেন,

"যাবি নাকি তাই বল।"

--"আমি কাল সকালে জানাই, একটু কাজ আছে।"

--"আচ্ছা জানাস।"


বিকালবেলা ছাদে গিয়ে বসলাম। গায়ে হলুদের স্টেজ বানানো হয়েছে। প্যান্ডেলের জন্য বাঁশ লাগানো হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।

  আমার ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এসব টিকবে তো?

  সন্ধ্যার আগে আগে অহনা ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। সে গিয়ে সুমনকে দেখে এসেছে।

  অহনাদের বাড়ি, ইস্কাটন রোডে। ইস্কাটন রোড থেকে বি.আর.বি হাসপাতাল পায়ে হাঁটা পনেরো মিনিটের পথ।

অহনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

"কি অবস্থা হয়েছে মানুষটার!"

আমি বললাম,

"আপনার সাথে কি কথা হয়েছে? আমি যখন গিয়েছিলাম সুমন তখন ঘুমিয়েছিল।"

অহনা কেঁদে ফেলে বলল,

"কথা হয়েছে। আমি যাবার কিছুক্ষণ আগে ও ঘুম থেকে জেগেছে। আমাকে দেখে কেঁদে দিয়েছে। পাশে বসিয়ে হাত ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছে।"

  আমি কিছু বলতে পারলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষকে আমি স্বান্তনা দেবার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাই না।


অহনার সাথে কথা বলে রাকিবকে ফোন করলাম। রাকিব মাত্র অফিস থেকে বের হয়েছে। আসতে কম করে হলেও আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে।

  ফোন রেখে একটা সিগারেট ধরালাম। ছাদের এক কোণে বসে গত কয়েকদিনের কথা ভাবছি-

  "হুট করে একটা চিঠি আসলো, এরপর আসলো কুরিয়ার। অহনাদের বাড়িতেও কুরিয়ার করা হলো। যে কুরিয়ার করেছে, সে তাঁর নাম ঠিকানা ভুল দিচ্ছে। আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানে আবার অহনাদের বাড়ির ঠিকানাও সে জানে। সুমনের সাথে অহনার সম্পর্কের কথা তো অহনার পরিচিত কেউ ছাড়া জানার কথা না। মানুষটা দিপা না তো।"

  আমি সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অহনাকে ফোন করলাম। অহনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।

আমি শান্তগলায় বললাম,

"আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। আপনার মানসিক অবস্থা ভাল নেই, বুঝতে পারছি না বলব নাকি বলব না।"

অহনা মৃদুস্বরে বলল,

"বলুন আমি ঠিক আছি।"

--"আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, চিঠি, কুরিয়ারের ব্যাপারগুলো দিপা করেছে।"

অহনা সাথে সাথে বলল,

"আপনি পাগল হয়েছেন? দিপা এসব করবে কেন? ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আপনি জানেন না?"

--"সন্দেহ হবার কারণ আছে। আপনি একটু ভেবে দেখুন। যে এসব করছে, সে যেমন আপনার বাড়ির ঠিকানা জানে, তেমনি আমার বাড়ির ঠিকানাও জানে। বেশকিছুদিন আগে আমরা বাড়ি বদলেছি, বন্ধুরা ছাড়া বাড়ির ঠিকানা তেমন কেউ জানে না। আমার বন্ধুরা এমন করবে বলে আমি বিশ্বাস করিনা। তাছাড়া দেখুন, আমার বন্ধুদের সুমনের সাথে আপনার সম্পর্কের কথা জানার কথা না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, যে এসব করছে সে আপনার খুব কাছের মানুষ। দিপা আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড সে আপনার সম্পর্কে কমবেশি জানার কথা।"

--"আপনি দিপার কথা বলছেন তো। দিপাকে সন্দেহ করার আর কোন কারণ আছে?"

--"গতকাল আপনার সাথে দিপার আমার দেখা হবার ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে?"

--"নাতো!"

--"তাহলে দিপা জানল কি করে আপনার সাথে আমার সামনা-সামনি কথা হয়েছে?"

--"ও আপনাকে এরকম কিছু বলেছে?"

--"হু। দুপুরে আপনার সাথে কথা বলার পর তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছে। তখন বলেছে।"

--"আর কি বলেছে?"

--"আর তেমন কিছু বলেনি। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আমার ফোন নম্বর সে পেয়েছে কোথায়? আপনার কাছ থেকে নিয়েছে?"

--"নাতো।"

--"আশ্চর্য! তাহলে আমার ফোন নম্বর সে পেল কোত্থেকে?"

--"আপনি জিজ্ঞাসা করেন নি?"

--"নাহ। আমি যেদিন প্রথম দিপাকে ফোন করি সে ফোন ধরেই জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন ভাইয়া। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন, সে বলল চিনব না কেন।  তাঁর সাথে আগে আমার কখনো কথা হয়নি, আমি কখনো তাকে ফোন নম্বর দেইনি, তাহলে চিনবে কি করে, ঘটনাটা তখন মাথায় আসেনি।"

--"আপনি আমাকে কনফিউজড করে দিলেন। দিপা কেন এরকম করবে?"

  রাকিব ফোন দিচ্ছে। অহনাকে পরে ফোন করব বলে রাকিবের ফোন ধরলাম।


রাকিব ধুপখোলা মাঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছাদ থেকে নেমে মাঠের দিকে চলে গেলাম।

  রাকিবকে নিয়ে দুই কাপ চা খেয়ে মাঠে গিয়ে বসলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে রাকিবকে বললাম,

"রাকিব, কি যেনো বলতে চাইছিলে?"

রাকিব, বিব্রতগলায় বলল,

"ভাইয়া আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।"

--"কেমন অপরাধ?"

--"আপনাকে না জানিয়ে আপনার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ডকে রিকোয়েস্ট দিয়েছি।"

--"এখানে অপরাধের কি আছে রাকিব?"

--"তারপরও পারমিশন নেওয়া দরকার ছিল।"

--"এটাই তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?"

--"না ভাইয়া। কথাটা ঠিক কিভাবে বলব, বুঝতে পারছি না।"

--"বলে ফেল।"

--"ভাইয়া, 'দিপালী চৌধুরী' কে কি আপনি চেনেন?"

--"হ্যাঁ। চিনব না কেন? কি হয়েছে বল তো।"

রাকিব ফোন বের করে চ্যাটবক্স ওপেন করে দিয়ে বলল, ভাইয়া পড়ে দেখুন।"


রাকিবের সাথে দিপার গত একমাসের কথোপকথন:

০৭ই জুন, ২০১৯

"হ্যালো আপু, কেমন আছেন?"

--"ভাল, আপনি কেমন আছেন?"

--"আমিও ভাল, আপু আমি তো আপনার চেয়ে অনেক ছোট, আমাকে তুমি অথবা তুই করে বললে খুশি হবো।"

--"আচ্ছা।"

--"আপু কি করছেন?"

--"বসে আছি। তুমি কি করছ?"

--"রান্না করছি আপু।"

--"তুমি রান্না করছ কেন? বাসায় কেউ নেই?"

--"আপু আমি তো মেসে থাকি। বুয়া দুদিন থেকে আসছে না।"

--"ও আচ্ছা। তুমি রাঁধতে পারো?"

--"মোটামুটি পারি।"

--"এখন কি রাঁধছ?"

--"আলু ভাজি করছি।"

--"ওয়াও! একদিন আমাকে দাওয়াত করে খাওয়িয়ো।"

--"আচ্ছা।"


১২ই জুন, ২০১৯

"হ্যালো আপু!"

--"কি অবস্থা? কেমন আছো?"

--"আপু ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?"

--"ভাল না।"

--"কেন আপু, শরীর খারাপ?"

--"নাহ।"

--"মন খারাপ?"

--"হু।"

--"কেন আপু? কি হয়েছে?"

--"এমনিতেই।"

--"বলা যাবে না?"

  কোন রিপ্লাই নেই...

--"আপু! হ্যালো, আপু কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? আপু?"

  কোন রিপ্লাই নেই...


১৬ই জুন, ২০১৯

"আপু কেমন আছেন?"

--"ভাল না।"

--"কেন আপু?"

--"এমনিতেই।"

--"মন খারাপ আপু?"

  কোন রিপ্লাই নাই..

রাত দুইটা,

"আপু মন ভাল হয়েছে?"

--"না।"

--"আমাকে বলা যাবে কি হয়েছে?"

--"জেনে কি করবে?"

--"আপু আমার আপনার মতো একজন বোন ছিল, সে আমি ছোট থাকতে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আপনাকে আপু বলে ডাকি, আপনার মন খারাপ থাকলে, আমারও খারাপ লাগে।"

--"কে বলেছে তোর বোন নাই, আমিই তো তোর বোন। এখন থেকে আমাকে আপু বলে ডাকবি।"

--"আপু তোমার মন খারাপ কেন?"

--"কিছু ভাল লাগে নারে। যাকেই আমি চাই সেই আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ঘুমা, পরে কথা হবে।"


২৫শে জুন, ২০১৯

"আপু, কেমন আছো?"

--"ভালো না।"

--"তোমার মন সবসময় এতো খারাপ থাকে কেন আপু?"

--"ভাইয়া তোকে একজনের ছবি পাঠাচ্ছি, তুই কম্পেয়ার করে আমাকে সত্যি সত্যি জানাবি কে বেশি সুন্দর, সে নাকি আমি। মিথ্যা বলবি না।"

--"আচ্ছা।"

  দিপা অহনার ছবি পাঠিয়েছে। রাকিব লিখেছে, "তুমি বেশি সুন্দর আপু। এতে কোন সন্দেহ নাই।"

--"মিথ্যা বলছিস?"

--"নাহ আপু। বোনকে কি কেউ মিথ্যা বলে?"

--"আচ্ছা বাবা হয়েছে।"


২৮শে জুন, ২০১৯

"আপু কি করছ?"

--"বসে আছি।"

--"কেমন আছো?"

--"খুব ভাল।"

--"আজকে হঠাৎ এতো ভালো আছো?"

--"আজকে আমি অনেক খুশি।"

--"এতো খুশির কারণ কি?"

--"পরে বলব।"


৩০শে জুন, ২০১৯

"ভাইয়া কেমন আছিস?"

--"ভাল, তুমি কেমন আছো?"

--"খুব ভালরে।"

--"তুমি তো আর বললে না?"

--"কী?"

--"ঐদিন এতো খুশি ছিলে কেন?"

--"তোকে একটা মেয়ের ছবি দিছিলাম না? ওর বিয়ে ভেঙে গেছে।"

--"এতে তুমি এতো খুশি কেন?"

--"ওর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তাকে তো আমি ভালোবাসি, ওর বিয়ে হবে আমার সাথে।"

--"বিয়ে ভাঙল কেন? কে ভেঙেছে ছেলেপক্ষ?"

--"নারে আমি ভেঙে দিছি।"

--"তাহলে তো খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু কিভাবে ভাংলে?"

--"পরে বলব।"


রাকিবের সাথে দিপার কথাবার্তা এই পর্যন্তই। আমি রাকিবকে জিজ্ঞাসা করলাম,

"তুমি কি শেষপর্যন্ত অহনাকে চিনতে পেরেছ?"

--"জ্বী ভাইয়া।"

--"কিভাবে চিনলে?"

--"আজ দুপুরে ফিরোজ স্যার সবাইকে ভাবীর ছবি দেখাচ্ছিলেন। সেখান থেকে দেখেছি। ভাইয়া, স্যরি, আমার ভুল হয়ে গেছে।"

--"তুমিকি জানো তুমি আমার কত বড় একটা উপকার করেছ?"

--"কেমন ভাইয়া?"

--"রাকিব, কয়দিন আগে অহনাদের বাসায় একজন কুরিয়ারে করে আমার অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। ছবিগুলো ফেইক। আমি এই কয়দিন অনেক চিন্তা করেও কে এমন কাজ করল ধরতে পারছিলাম না, আজ সন্ধ্যা থেকে দিপাকে সন্দেহ করছি, কিন্তু প্রমাণ পাচ্ছিলাম না। তুমি আজকে রাতে আমাদের বাসায় থাকো। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে তোমার ভাবীদের বাসায় যাবো। তোমার আপুর কর্মকাণ্ড ফ্ল্যাশ করে দিলে সমস্যা নাই তো?"

--"ভাইয়া কি যে বলেন!"


রাতে রাকিবকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অহনাকে ফোন করে বললাম, সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, দিপাকে সে যেন সকাল দশটার দিকে তাদের বাসায় আসতে বলে।

অহনা বলল,

"কোত্থেকে প্রমাণ পেলে? স্যরি, কোত্থেকে প্রমাণ পেলেন?"

--"কাল সকালে বলব। আর হ্যাঁ, দিপাকে কিন্তু এসব ব্যাপারে কিছু বোলো না, স্যরি বলবেন না। সে যেন কিছু জানতে না পারে।"

--"আচ্ছা।"


সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাবা বললেন,

"যাবি আজকে?"

আমি বললাম,

"বাবা আজকে একটা কাজ আছে, কাল যাই?"

--"আচ্ছা। কাল তাহলে মিস করিস না। এখন উঠে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা কর।"


সকাল সাড়ে নয়টায় রাকিবকে নিয়ে অহনাদের বাসায় গেলাম। অহনার বাবা, আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছেন। মনে হচ্ছে, আমাকে তিনি চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারলে শান্তি পান। অহনা রাকিবের ফোনে দিপার ম্যাসেজ পড়ছে। আমি আর রাকিব মাথা নিচু করে বসে আছি।

  দিপা আসল সোয়া দশটার দিকে, বসার ঘরে ঢুকতে গিয়ে রাকিবকে দেখে তাঁর হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেল।

হবু শ্বশুরমশাই দিপাকে বললেন,

"আসো মা আসো।"

  দিপা শ্বশুরমশায়ের পাশের সোফায় গিয়ে বসল।

আমি আনন্দিত গলায় বললাম,

"মিস দিপা, ঘটনাটাকি আপনি বলবেন? নাকি রাকিব দেখাবে?"

  দিপা মাথা নিচু করে বসে রইল। শ্বশুরমশাই বললেন, ঘটনাটা কী?

  দিপা একবার মাথা উঁচু করে কিছু বলতে গিয়েও আবার মাথা নিচু করে ফেলল।

আমি বললাম,

"বাবা, আপনি যেই ছবিগুলোর কারণে আমাকে লম্পট বলেছিলেন, সেই ছবিগুলো ছিল ফেইক। ছবিগুলো বানিয়েছিন তিনি।"

অহনা বলল,

"দিপা, তোকে আমি এতো বিশ্বাস করতাম, আর তুই এমন করলি? ছি!"

  শ্বশুরমশায়ের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি বিরক্তমুখে অহনাকে বললেন,

"কি হচ্ছে এসব?"

অহনা বলল,

"বাবা তোমাকে আমি পরে সব বুঝিয়ে বলব।"

  দিপা কোন কথা বলছে না।

অহনা ফের বলল,

"তুই এসব কেন করলি? আমাকে একটাবার বলতে পারলি না?"

দিপা সোফা থেকে উঠে, চেঁচিয়ে বলল,

"করেছি বেশ করেছি।" -বলেই সে দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল...


আমাদের বিয়ের মাসখানেক পরের কথা...

রাতে অহনাকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়েছি। বগুড়া যাবো ঠিক করেছি। বগুড়ায় দুদিন থেকে ঘুরে-ফিরে বাড়ি ফিরব।

সিরাজগঞ্জ পেরিয়ে অহনাকে বললাম,

"দিপা মেয়েটার খবর কী?"

অহনা চট করে বলল,

"ওর খবর আমি জানব কি করে?"

--"মেয়েটার মাথায় কিন্তু বুদ্ধি আছে।"

  অহনা কোন কথা বলল না।

আমি বললাম,

"যদি শেষ পর্যন্ত দিপার কর্মকাণ্ড ধরা না পড়তো তাহলে কি হতো বল তো।"

অহনা ঘুমঘুম গলায় বলল,

"কি আর হতো তোমার সাথে আমার বিয়েটা হতো না।"

--"আরও একটা ঘটনা ঘটত।"

--"কী?"

--"আমি গলায় রশি দিয়ে মরতাম।"

--"হোয়াট?"

--"সত্য কথা বললাম, এমন সুন্দরী বউ পেয়ে হাতছাড়া হয়ে গেলে, মরা ছাড়া আর উপায় আছে?"

--"খুব পটানোর চেষ্টায় আছো দেখছি।"

--"বিয়ের আগে তো প্রেম করতে পারলাম না, এখন একটু চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?"

অহনা হাই তুলতে তুলতে বলল,

"ঢং না? বুঝি বুঝি আমি সব বুঝি।"

--"কি বোঝ তুমি?"


অহনা বিরক্ত হবার ভঙ্গি করে বলল,

  "Shut up and drive"

...

#সমাপ্ত 

বিঃদ্রঃ গল্পটা শেষ পর্যন্ত কেমন লাগল? একটা মাত্র গল্প শেষ হলো, আরও অসংখ্য গল্প বাকি আছে। আশা করছি, পরের গল্পগুলো পড়বেন।


- ধন্যবাদ।